ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫
আপডেট : ২৮ জুলাই, ২০১৮ ১৬:১৪

ক্রেতা সংকটে বেনারসি পল্লী

নিজস্ব প্রতিবেদক
ক্রেতা সংকটে বেনারসি পল্লী

ক্রেতা সংকটে ধুঁকছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী শাড়ি বেনারসির সবচেয়ে বড় বাজার রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লী। একই সঙ্গে কাজকর্ম কমে দেশের প্রাচীনতম এই শিল্পের কারিগরদের।

মিরপুর বেনারসি পল্লীর আধুনিক যুগের বয়স তিন যুগের মতো হলেও এর যাত্রা শুরু ১৯০৫ সালে। শত বছর ধরে এখানে বেনারসি বোনা ও বেচাবিক্রি হয়ে আসছে। তবে গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকেও অর্থাৎ ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে গদিঘর ছিল না তেমন।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বাড়তে থাকে গদিঘর ও উদ্যোক্তা। বেনারসি কারখানাগুলো অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে সেখানে বসে আধুনিক শোরুম। বেনারসি, কাতান, জামদানি- এসব ঐতিহ্যবাহী শাড়ির টানে বেনারসি পল্লী হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।

কিন্তু বছর খানেক থেকে ভাটা পড়েছে তাদের ব্যবসায়। যানজট, বৃষ্টিতে জলজট, মেট্রোরেল নির্মাণকাজের জন্য রাস্তা সরু হয়ে যাওয়া আর ধুলার রাজ্য, সেই সঙ্গে ভারত থেকে বৈধ-অবৈধ পথে কাপড় আসায় বেনারসি পল্লী হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

মূলত মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই তাদের ব্যবসায় ভাটা শুরু বলে জানান বেনারসি ব্যবসায়ীরা।

দেশের প্রথম মেট্রোরেল উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে পল্লবী হয়ে রোকেয়া সরণি-খামারবাড়ী-ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে পর্যন্ত যাবে। এখন চলছে এই রেলপথ তৈরির কাজ।

সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের মাঝখানের বড় একটা অংশজুড়ে কাজ চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের। ফলে সড়কটি বেশ সরু হয়ে পড়ায় কেবল দুই পাশের কিনার ঘেঁষে চলাচল করে গাড়ি। আর এই অংশটুকু ভেঙেচুড়ে খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ফলে যানজট নিত্যসঙ্গী। বৃষ্টি হলে পানিতে তলিয়ে যায়।

বেনারসি পল্লীতে ‘পরশমণি’ নামে দুটি দোকান আছে মো. মাসুদ রানার। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। শুধু আমার না সবার। সব সময় রাস্তায় যানজট থাকে, বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে। ফলে আমাদের ক্রেতারা এখানে আসতে পারছেন না।’

মেট্রোরেলকে দেশের সম্পদ আখ্যা দিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা চাই মেট্রোরেল হোক। এটা আমাদেরই কাজে লাগবে। কিন্তু কাজটা আরো দ্রুত করা উচিত। যে জায়গাগুলো খানাখন্দে ভরা, যেসব স্থানে পানি জমে, সেগুলো ঠিক করা হলেও পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।’

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে আসে বেনারসি শিল্পের আরও কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা। এর মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভারতীয় ভিসার সহজলভ্যতা দেশীয় বেনারসি শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

কেন?

ব্যবসায়ীরা বলেন, নিম্নবিত্ত ছাড়া দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এখন ভারতে যাতায়াত করেন। ফেরার পথে অনেকেই সেখান থেকে শাড়ি-লেহেঙ্গাসহ অন্যান্য কাপড়-চোপড় কিনে নিয়ে আসেন। এতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

ভারতীয় বেনারসির তুলনায় দেশীয় বেনারসি মানের দিক থেকে অনেক এগিয়ে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।

তবে কেবল সরকারকে দোষ দেয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন রূপসী বেনারসি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. আবুল কালাম। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে তারা দায়িত্ব পালন করছে না। যানজট, জলাবদ্ধতা ও ভারতের ভিসা সহজলভ্যতা আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির প্রধান কারণ।’

দেশীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের করণীয় সম্পর্কে রূপসী বেনারসির  মালিক বলেন, ‘প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হবে কি না কে জানে। দেশের বাইরে থেকে যেন কেউ পণ্য নিয়ে আসতে না পারে,  এটা অন্তত নিশ্চিত করা হোক।’

নামে বেনারসি পল্লী হলেও এখানে পাওয়া যায় প্রায় ২০-২৫ ধরনের কাপড়। তবে চাহিদায় এগিয়ে পিওর বেনারসি, দুলহান বেনারসি ও কটন বেনারসি। চাহিদা আছে জর্জেট কাতান, পার্টি কাতান, ওপেরা কাতান, মাসলাইস কাতান, ফুলকলি কাতান, যশোর কাতান, বালুচরি কাতান, টিস্যু কাতান, পিওর সিল্ক ও নানা রকম জামদানির।

বেনারসি শাড়ির বড় একটা অংশ তৈরি হয় মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে। সেখানে বেনারসির কারিগর হলেন একাত্তরে এদেশে আটকে পড়া বিহারিরা। তারাই জামদানি, বেনারসি, কাতান বোনে। ক্রেতা সংকটে কাজ কমে গেছে তাদের।

জেনেভা ক্যাম্পের বেনারসি কারিগর মো. চান  বলেন, ‘আগে ভারত থেকে আমরাই পাতি, পুতি, পাথর আনতাম। তারপর এখানে বানাইতাম। এখন সবাই যাইতাছে, যে যার মতো নিয়া আইতাছে।’

কাজ কমে যাওয়ায় অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন জানিয়ে মো. চান আশঙ্কা প্রকাশ করে, এ অবস্থা চলতে থাকলে বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে বাধ্য হবেন অধিকাংশ কারিগর ও ব্যবসায়ী।

দেশীয় বাজারে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে আরও বিস্তার করে দেশের বাইরে এবং বিদেশি মেলায় অংশ নিতে চান অনেক বেনারসি ব্যবসায়ী। এ ব্যাপারে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পাশাপাশি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা সুতা ও কাপড় শুল্কমুক্ত করলে তা বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে মনে করেন তারা।

উপরে