logo
আপডেট : ২৩ জুলাই, ২০২০ ১৯:০৫
নিজামের বিপুল সম্পদ নিয়ে বিবাদে ভারত-পাকিস্তানও
অনলাইন ডেস্ক

নিজামের বিপুল সম্পদ নিয়ে বিবাদে ভারত-পাকিস্তানও


এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তকমা পেয়েছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজাম। রাজা-জমিদারির যুগ আর নেই। তবে আলোচনায় রয়ে গেছে হায়দ্রাবাদের নিজাম পরিবার।
লন্ডনের একটি ব্যাঙ্কে বহু বছর ধরে গচ্ছিত হায়দ্রাবাদের নিজামের প্রায় সাড়ে চার কোটি ডলারের সম্পদ নিয়ে আইনি লড়াই আরও জটিল হয়েছে। এই বিপুল অঙ্কের অর্থের মালিকানা পাওয়ার লড়াইতে যেমন নিজামের বংশধররা আছেন, তেমনি জড়িত আছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানও।
হায়দ্রাবাদের সপ্তম নিজাম মির ওসমান আলি খানের নাতি প্রিন্স মুকররম জাহ্ ও প্রিন্স মুফফাকাম জাহ্, যারা এখন তুরস্কে বসবাস করেন, তাদের সঙ্গে এই সম্পদ নিয়ে ভারত সরকারের একটি 'গোপন সমঝোতা' হয়েছিল।
গত বছরের অক্টোবরে লন্ডনের একটি আদালত তাদের পক্ষেই রায় দেয় এবং নিজামের বংশধররা ও ভারত কীভাবে এই সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কোর্টকে জানাতে বলে। জাস্টিস মার্কাস স্মিথ এই সম্পদের ওপর পাকিস্তানের দাবি 'বেআইনি' বলেও খারিজ করে দেন।
কিন্তু এখন হায়দ্রাবাদের নিজামের পরিবারের আরও শতাধিক বংশধর নওয়াব নাজাফ আলি খানের নেতৃত্বে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং ওই অর্থের ওপর নিজেদের মালিকানা দাবি করেছেন।
বুধবার ভারত থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে লন্ডনের আদালতে নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন নওয়াব নাজাফ আলি খান, যিনি এই মামলায় নিজামের পরিবারের মোট ১১৭ জনের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বিচারপতি অবশ্য পুরনো মামলাটিতে এখনও নতুন করে আবার শুনানি শুরু করতে রাজি হননি।
তবে সপ্তম নিজামের বিপুল ধনসম্পদ তদারকি করার জন্য নিযুক্ত প্রশাসকদের কথিত দুর্নীতি নিয়ে এদিন (বৃহস্পতিবার) তিনি আবেদনকারীদের বক্তব্য শুনতে রাজি হয়েছেন। ফলে নিজামের ধনসম্পদ নিয়ে সত্তর বছরেরও বেশি পুরনো এই বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আবারও আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই বিরোধের সূত্রপাত কীভাবে?
বস্তুত নিজামের এই সম্পদ নিয়ে বিতর্কের শুরু দেশভাগ বা 'পার্টিশনে'র ঠিক পর পরই। ১৯৪৮ সালে, ভারতের স্বাধীনতার কয়েকমাস পরেই হায়দ্রাবাদের তৎকালীন নিজাম সপ্তম আসাফ জাহ্ (মির ওসমান আলি খান) লন্ডনের পাকিস্তান হাই কমিশনে দশ লাখ পাউন্ড ও একটি গিনি (স্বর্ণমুদ্রা) পাঠিয়েছিলেন।
হায়দ্রাবাদ তখনও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু ভারত যদি হায়দ্রাবাদ দখলে কোনো অভিযান চালায়, সেই জন্য পাকিস্তান সেই অর্থ 'নিরাপদে গচ্ছিত রাখবে' সেই ভরসায় আগেভাগেই নিজাম ওই টাকাপয়সা লন্ডনে পাঠিয়ে দেন।
নিজামের অর্থমন্ত্রী মঈন নওয়াজ জং সেই টাকাপয়সা লন্ডনের ন্যাশনাল ওয়স্টেমিনস্টার (ন্যাটওয়েস্ট) ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেন পাকিস্তানের হাই কমিশনারের নামে।
লন্ডনে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হাবিব ইব্রাহিম রহমতউল্লা সেই অর্থ জমা রাখেন লন্ডনের একটি ব্যাঙ্কে, সপ্তম নিজাম ও ভবিষ্যতের নিজাম খেতাবধারীদের নামাঙ্কিত একটি ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে।
কিন্তু এদিকে লন্ডনে টাকাপয়সা পাঠিয়ে দেয়ার কয়েকদিন পরেই নিজাম মত পাল্টান, তিনি ব্যাংককে জানান ওই অর্থ তার সম্মতিক্রমে পাঠানো হয়নি এবং তিনি সেটা এখন ফেরত চান। কিন্তু ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংক সেই টাকা তখন ফেরত দিতে রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, ওই অ্যাকাউন্ট নিজামের ব্যক্তিগত নয় এবং ওই তহবিলের ওপর পাকিস্তানের 'লিগাল টাইটেল' বা আইনি অধিকার আছে, সুতরাং তাদের সম্মতি ছাড়া টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।
নিজাম ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হন। প্রায় গোটা পঞ্চাশের দশক জুড়েই তিনি ন্যাটওয়েস্টের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আদালতে মামলা চালিয়ে গেছেন।
বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ওয়েস্টমিনস্টারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও গড়ায়। হাউস অব লর্ডস সিদ্ধান্ত নেয়, এই অর্থের মালিকানা নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও নিজামের পরিবার একমত না-হওয়া পর্যন্ত তা ব্যাঙ্কেই 'ফ্রোজেন' থাকবে - অর্থাৎ সে টাকাপয়সা কেউ তুলতে পারবে না বা অন্য কোথাও সরাতেও পারবে না।
এখন বাহাত্তর বছর ধরে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সেই টাকাই সুদে-আসলে বেড়ে আজ হয়েছে পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় সাড়ে চার কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি রুপি।
নিজামের বিপুল অর্থ নিয়ে বিতর্ক আবার লন্ডনের আদালতে গড়ায় ২০১৩ সালে, যখন পাকিস্তান সরকার ন্যাটওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে বসে। প্রায় ৬৫ বছর আগে পাকিস্তান ওই অর্থের ওপর যে 'সভেরেইন ইমিউনিটি' প্রয়োগ করেছিল সেটা প্রত্যাহার করে নিয়ে তারা ওই অর্থের মালিকানা দাবি করে।
সেই মামলায় মূল প্রশ্নটা ছিল, ১৯৪৮ সালে যখন হায়দ্রাবাদ থেকে লন্ডনের ব্যাঙ্কে অর্থ পাঠানো হয়েছিল তার 'বেনেফিশিয়ারি' বা প্রাপক কে ছিলেন - পাকিস্তান না কি নিজাম?
ভারত সরকারও ইতিমধ্যে তুরস্কে বসবাসকারী নিজামের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছয় এবং গত বছর আদালতের রায়ও তাদের অনুকূলেই যায়।
এদিকে হায়দ্রাবাদে নিজামের পরিবারেরই একটি শাখা ওই অর্থের ওপর মালিকানা দাবি করে বছরকয়েক আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
'নিজাম ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে'র প্রেসিডেন্ট নওয়াব নাজাফ আলি খান তখন দেখা করেছিলেন ভারত ও পাকিস্তান, উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গেও।
নাজাফ আলি খানের যুক্তি ছিল, লন্ডনের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ওই অর্থ কোনো রাষ্ট্রের নয়, নিজাম পরিবারের। ফলে সেটার ওপর প্রধান দাবি নিজামের প্রায় ১২০জন 'ওয়ারিশ' বা উত্তরাধিকারীর।
হায়দ্রাবাদের নিজাম মির ওসমান আলি খান (১৮৮৬-১৯৬৭), যাকে ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম ধনী ও একটা সময় সারা বিশ্বেরও সবচেয়ে সম্পদশালী বলে গণ্য করা হয়, তার বংশধররা এখন 'চরম অর্থকষ্টে' আছেন বলেও তিনি সে সময় উল্লেখ করেছিলেন।
নিজামের রেখে যাওয়া বিপুল ধনসম্পদের একটা অংশ পাওয়ার জন্যই তার সেই শতাধিক বংশধর এখন লন্ডনের কোর্টে একটা শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। সূত্র: বিবিসি


প্রকাশক/সম্পাদক: আবুল হারিস রিকাবদার
প্রকাশক ও সম্পাদক কর্তৃক প্রথম বাংলাদেশ/শিবপুর, নরসিংদী থেকে প্রকাশিত
ফোনঃ বার্তা-০১৭০০-০০০০০০, বিজ্ঞাপন-০১৯০০-০০০০০০, ই-মেইলঃ prothombangladeshnews@gmail.com