বইয়ের প্রতি মানুষের এক দুর্নিবার টান। সেল ফোন, ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের যুগে এখনো মানুষ বই পড়ে। অনেকে বইয়ের বদলে ই-বুক পড়ে, কিন্তু বই তো। তারপরেও আধুনিককালে একটা বিতর্ক লেগেই থাকে বইয়ের পাঠক কি কমে যাচ্ছে? যদিও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই।
এমনও হতে পারে প্রযুক্তির চাপে; টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট প্রভৃতির ব্যবহারের কারণে মানুষের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমছে। তবে প্রতিবছর বইমেলায় আবার বই বিক্রি বাড়ছে। ফলে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

অবশ্য বেশ কয়েকটি জরিপের ফল জানাচ্ছে, বিশ্ব জুড়েই তরুণদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কমছে। তারপরেও এখনো প্রায় সব দেশেই মেয়েরা বই পড়ায় এগিয়ে। বাংলাদেশেও। তারপর ছেলেদের স্থান। আর সবচেয়ে বই কম পড়ে কারা জানেন, তরুণরা। সোশ্যাল মিডিয়া, গেম আর সেলিব্রেটি পেজে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য কিডস অ্যান্ড ফ্যামিলি রিডিং রিপোর্ট’ বলছে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি ২৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরীরা সপ্তাহে পাঁচ থেকে সাত দিন বই পড়ে। এই শতকরা হার আরো নিচে নেমে ১৭ শতাংশে এসে থেমেছে যখন টিনএজারদের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে। ১৫ থেকে ১৭ বছরের কিশোরদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। আর এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যখন দেখা গেছে, এরা দিনের ৭৬ শতাংশ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়। এবার দেখা যাক এখনো যারা শিশু এবং যারা কয়েক বছরের মধ্যেই টিনএজার হবে—তাদের কী অবস্থা। ৬ থেকে ৮ বছরের শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই সেল ফোনে অ্যাপসের মাধ্যমে গেম খেলে। আর ৩৪ শতাংশ ইউটিউব এ ভিডিও দেখে কাটায়।
তাহলে বছর জুড়ে যে এত বই বের হচ্ছে এসব বই কারা পড়ে? জরিপ বলছে মূলত সিনিয়র সিটিজেনরাই বেশি বই পড়েন। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের গতিবিধি কম তাই তাদের কাছেই রয়েছে বইয়ের কদর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকান টাইম ইউজ সার্ভে’ এবং ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ারের দুটি জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির সভাপতি লোকবিদ শামসুজ্জামান খান বলেন, প্রযুক্তির বিকাশের কারণে বাংলাদেশে বই বিক্রি কিন্তু কমেনি। দিন দিন বই বিক্রি বাড়ছে। যদি নাই বাড়বে তাহলে এত প্রকাশক বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহী কেন হচ্ছে? প্রতিবছর নতুন নতুন প্রকাশক আসছে। এসব প্রমাণ করে বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। বইয়ের চাহিদা রয়েছে। প্রকাশনার মানও দেশে আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। এটা ঠিক যে তরুণদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় থাকার প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে তরুণদের একটা অংশের মধ্যে বইবিমুখতা রয়েছে। এর উলটো চিত্রও রয়েছে। কিছু কিছু তরুণ বেশ সিরিয়াসলি সাহিত্য পাঠ করছে, চর্চা করছে
উল্লেখ্য, এবার দেশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা হচ্ছে না। করোনা মহামারির কারণে তা পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে মার্চে। পেছালেও প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে বইমেলার। এক মাস পরেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে বসবে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা

এদিকে অনেকে মনে করেন, গত বিশ বছরে দেশে নতুন কোনো পাঠকপ্রিয় লেখককে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যায়নি। হূমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক এবং হরিশংকর জলদাসের পরে আর কোনো লেখককে সেভাবে উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়েও নানা জনের নানা মত। ভালো লেখককে পাঠক খুঁজে নেবে নাকি লেখককেই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, পাঠকের লেখককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রয়েছে। অনেকের মতে, মাথাচাড়া দিয়ে সবার নজরে পড়ার বিষয়টা লেখককেই ঘটাতে হয়। নতুন লেখক উঠে আসার এটাই প্যাটার্ন।
এ প্রসঙ্গে শামসুজ্জামান খান বলেন, এটা ঠিক যে অনেকটা সময় ধরে নতুন পাঠকপ্রিয় লেখক উঠে আসছে না। তবে অনেকেই রয়েছেন যারা এখনো সেভাবে উঠে না এলেও খুব ভালো কাজ করছেন। যারা সাহিত্যের চিরাচরিত ধারার বাইরে গিয়ে কাজ করছেন, আকর্ষণীয় কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমাদের সাহিত্য তো স্থবির হয়ে গিয়েছিল। আমাদের গল্প লেখার গতানুগতিক প্যাটার্ন হয় গিয়েছিল। সেই জায়গায় নতুন নতুন লেখকরা নতুন আঙ্গিক নিয়ে হাজির হচ্ছেন পাঠকদের সামনে। আমি এই তরুণ লেখকদের নিয়ে আশাবাদী।
কেন বই পড়ে মানুষ: মানুষ তো সারাদিনই কিছু না কিছু পড়ছেই। সেল ফোনে এসএমএস, ফেসবুকের আপডেটস, খবরের কাগজ, রাস্তায় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। এত কিছু পড়ার পরেও বই কেন পড়তে ইচ্ছা করে? ইউরোপে পরিচালিত একটি গবেষণা বলছে, নানা কারণে বই পড়ে মানুষ। তবে অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধানত জ্ঞান আহরণের জন্য। এত সবারই জানা যে বই পড়লে জ্ঞান বাড়ে। শুধুই এই, আর কিছু না? জ্ঞানের আগ্রহে মানুষ বই পড়ছে শুধু এইটা তো একমাত্র কারণ হতে পারে না? তাহলে তো স্কুল-কলেজে কেউ ফলাফল খারাপ করত না। বা ক্লাসের মধ্যে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ত না। তাহলে কেন বই পড়ে মানুষ? ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে বই পড়ার দশটি কারণ বলা হয়েছে।
মনোসংযোগ, স্মৃতিশক্তি বাড়ানো, চিন্তার স্বচ্ছতার জন্য, বলবার দক্ষতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা, লিখবার দক্ষতা বাড়ানো, বিনোদন, অবসাদ কাটানো প্রভৃতি কারণে বই পড়ে মানুষ। কিন্তু সবচেয়ে প্রথমে যে বিষয়টিকে তারা রেখেছে সেটি হচ্ছে ‘মানসিক উদ্দীপনা’। বই পড়লে মানুষ মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়। সেই কারণেই বই পড়ে মানুষ। যখন মানুষ বই পড়ে তখন কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। যা বিশ্বাস করত না, তা বিশ্বাস করে প্রাণিত হয়, বইয়ের প্রাণহীন পাতাগুলো মানুষের মনের স্পর্শে প্রাণ পায়। ডানা মেলে আকাশে। সেই উদ্দীপ্ত মানুষগুলো বইয়ের সংস্পর্শে অসাধ্যকে সাধন করতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। আর সে কারণেই এই বিজ্ঞানের বিস্ফোরণের যুগেও বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি মানুষ।