logo
আপডেট : ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ ১৮:৪৫
কোন অপরাধে কী সাজা দিলেন ট্র্যাইব্যুনাল
নিজস্ব প্রতিবেদক

কোন অপরাধে কী সাজা দিলেন ট্র্যাইব্যুনাল

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আজ সোমবার দুপুরে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এর আগে দুপুর পৌনে ১টার দিকে ছয় অধ্যায়ে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু হয়।

রায়ে কী বলা হয়

রায়ে বলা হয়, ‘আমরা ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই মত দিচ্ছি যে, তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় নির্বিচারে ও নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করে যে ঘৃণিত অপরাধ করেছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে না।’

 

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির অপরাধ প্রমাণিত। দুটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

কী অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে চার্জ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগগুলো হলো– 

প্রথম অভিযোগ: গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শেখ হাসিনার ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্যের পর আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীরা’ ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। এরই অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ করতে আসামিদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগ: শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ দিয়েছেন। এ ছাড়া তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ: রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গত বছরের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উস্কানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আসামিরা জ্ঞাতসারে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে।

চতুর্থ অভিযোগ: ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শাহরিয়ার খান আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে। এর মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিরা তাদের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

পঞ্চম অভিযোগ: ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশের এলাকায় গত বছরের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছয় শিক্ষার্থীকে তৎকালীন সরকারের পুলিশ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃতদেহ ও একজনকে জীবিত এবং গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় হত্যা, নির্যাতন, মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

কোন অপরাধে কী সাজা দিলেন ট্র্যাইব্যুনাল

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

এগুলোর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছে পাঁচটি অভিযোগ তিনটি কাউন্টে ভাগ করে সাজা প্রদান করা হয়েছে আসামিদের। তাদের বিরুদ্ধে গঠন করা প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উল্লেখ করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী’ ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। প্ররোচনা, উস্কানি, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, ষড়যন্ত্রের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে এতে। 

এই অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, তিনি অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ‘ইমপ্রিসনমেন্ট টিল ন্যাচারাল ডেথ’ অর্থাৎ আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন।

তিনটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

এর মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ দিয়েছেন।

চার নম্বর অভিযোগে, গত বছরের ৫ অগাস্ট রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ছয় জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

পাঁচ নম্বর অভিযোগ আশুলিয়াতে জীবিত একজনকেসহ মোট ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার চাঁনখার পুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়াতে জীবিত একজনসহ ছয়জনকে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এদিকে, এই মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি ও ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে প্রথম অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অপরাধের ব্যাপকতা এবং যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেসব অপরাধ তিনি করেছেন সেগুলোর জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য।

কিন্তু, যেহেতু তিনি এই মামলাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাহায্য করেছেন সে বিষয় বিবেচনায় তিনি ন্যুনতম সাজা পাবেন।

ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরও বলেছে, তিনি সব এট্রোসিটিজের জন্য দায়ী। কিন্তু ঘটনার বিবরণ পূর্ণাঙ্গভাবে ডিসক্লোজ করেছেন তিনি। এসব বিষয় বিবেচনায় সাবেক এই আইজিপিকে ট্রাইব্যুনাল পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।


প্রকাশক/সম্পাদক: আবুল হারিস রিকাবদার
প্রকাশক ও সম্পাদক কর্তৃক প্রথম বাংলাদেশ/শিবপুর, নরসিংদী থেকে প্রকাশিত
ফোনঃ বার্তা-০১৭০০-০০০০০০, বিজ্ঞাপন-০১৯০০-০০০০০০, ই-মেইলঃ prothombangladeshnews@gmail.com