logo
আপডেট : ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৪:৩৫
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে ১৬১ সুপারিশের বাস্তবায়ন ৮২টি
নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে ১৬১ সুপারিশের বাস্তবায়ন ৮২টি

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ১৬১টি সুপারিশের মধ্যে অন্তত ৮২টি বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশে ১৩টি বাস্তবায়ন হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীসহ বিভিন্ন আইন-বিধি সংশোধনের মাধ্যমে আরও অন্তত ৬৯টি সুপারিশ কার্যকর হয়েছে। কিছু সুপারিশের অবশ্য আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে।

আজ সোমবার আইন মন্ত্রণালয় থেকে আরপিও অধ্যাদেশ জারির পর এর আলোকে ইসি এখন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা জারির উদ্যোগ নিচ্ছে। সেখানেও সংস্কার কমিশনের আরও কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ রয়েছে। 

 

এছাড়া জুলাই জাতীয় সনদের কয়েকটি দফায় কমপক্ষে ২০টি সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যার অনেকগুলো আবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় একত্রে সনদে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কমপক্ষে ৪৯টি সুপারিশ কোনো পর্যায় থেকেই আমলে নেওয়া হয়নি। ১০টির মতো সুপারিশ ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মূহাম্মদ ইউনূস গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। যার মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্যতম। পরে ওই বছরের ৩ অক্টোবর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে সাত সদস্যের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। 

 

কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয় এই কমিশনের কার্যক্রম। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মী ও শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন অংশীজন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৮টি ক্ষেত্রে ১৬১টি সুপারিশ করে কমিশন। ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের সারসংক্ষেপ তুলে দেওয়া হয়। পরে ১৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। 

উল্লেখযোগ্য বাস্তবায়ন

গত ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানানো হয়, সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা (স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক) এবং হলফনামার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এতে ও ইসি অনেকগুলো নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত অনেকগুলো আইন ও বিধিমালা করেছে। 

এসব আইন ও বিধির ফলে সংস্কার কমিশনের সুপারিশকৃত যেকোনো আদালত ঘোষিত ‘ফেরারি আসামি’ ও আইসিটি আইনে শাস্তিপ্রাপ্ত ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সংসদ নির্বাচন থেকে বিরত রাখা; বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ; নির্বাচনি তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া ব্যক্তিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা; নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পৃথক সার্ভিস সৃষ্টি; পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগদান এবং কারিগরি বিশেষজ্ঞ ও দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বিশেষায়িত কমিটির মাধ্যমে সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে। ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠনে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় রাখার তথ্য জানিয়েছে ইসি।  

গত ৩ নভেম্বর জারি হওয়া আরপিও'র সংশোধনী অধ্যাদেশেও এসব সুপারিশসহ সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার সুযোগ রহিত করে সরাসরি দাখিল; শুধু একক প্রার্থিতায় ‘না’ ভোট (সুপারিশের আংশিক বাস্তবায়ন); নির্বাচনে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে ফিরিয়ে দেওয়া; জোটে থাকলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করা এবং ভোটার প্রতি ১০ টাকা হারে নির্বাচনি ব্যয়ের বিধান। 

নির্বাচনে হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিল-সংক্রান্ত কমিশনের চার সুপারিশ পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক আকারে আরপিওর সংশোধনীতে যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। ওই প্রার্থী নির্বাচিত হলেও তার পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে ইসি স্বপ্রণোদিত হয়ে বা কোনো তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাকে রিকল করতে পারবে এবং মিথ্যা তথ্য দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে- এমন বিধানও যুক্ত হয়েছে আরপিওতে। 

এদিকে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে আমলে নিয়ে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় বিদ্যমান বাহিনীর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী তথা সেনা, নৌ, বিমান ও কোস্টগার্ডকে যুক্ত করা; ইভিএম-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রভিশন বিলুপ্ত; নির্বাচন কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের অবহেলাজনিত শাস্তিগুলো সুনির্দিষ্ট করা; তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে ইসিকে অবহিত করা; নির্বাচন কমিশনের অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক এবং সংবাদকর্মীদের কেন্দ্রে প্রবেশের বিধান যুক্ত করা; নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থীদের ব্যয়ের নিরীক্ষা (অডিট) করা; সব দলের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অনুদান গ্রহণের বাধ্যবাধকতাসহ দলের বার্ষিক রিটার্ন বা দলীয় ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা ও অনুদানের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ লাখ টাকা করা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত পুলিশ ও প্রশাসনের নিয়োগ-বদলি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।   

এছাড়া আরপিওতে প্রার্থী মনোনয়ন ফরমের তপশিল আরও সুনির্দিষ্ট করা; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ইত্যাদি ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের মিথ্যাচার বা অপবাদ ছড়ানো ইত্যাদির ব্যাপারে প্রার্থী, দল ও সংস্থাসহ সবার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান; নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টারের ব্যবহার বাতিল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে আচরণবিধি ভঙ্গ না করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্তত ২০টি সুপারিশ (সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একত্রে) ২, ১৪, ১৬, ২৩, ২৭, ৩৮, ৪৪, ৪৯, ৬২ ও ৬৪ দফায় যুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার মনোনয়ন প্রভৃতি।  

বাস্তবায়ন হয়নি যেসব সুপারিশ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং কমিটির সভাপতি বা সদস্যদের ভোটে অংশ নিতে চাইলে ওইসব পদ থেকে পদত্যাগ করার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ ছিল সংস্কার কমিশনের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান করার সুপারিশ ছিল সংস্কার কমিশনের। এই দুইটি সুপারিশ ইসির আরপিওতে রাখা হয়নি। অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সুযোগ রাখার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবও বিবেচনায় নেয়নি ইসি। আউয়াল কমিশন থেকে নিবন্ধন পাওয়া বিতর্কিত দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ যেমন বাস্তবায়ন হয়নি, তেমনি নতুন দল নিবন্ধনে শর্ত শিথিলের সুপারিশ আমলে নেয়নি ইসি। এছাড়া সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য তিন বছরে দলীয় সদস্য পদ থাকা বাধ্যতামূলক করাসহ প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় আরও কয়েকটি সুপারিশও আমলে নেওয়া হয়নি।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেছেন, কমিশনের সুপারিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রায়ণ, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ও বিদেশি শাখা বিলুপ্তির প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি। প্রার্থী হওয়ার ৬ মাস আগ থেকেই ঋণ খেলাপি মুক্ত হতে হবে এমন প্রস্তাবও বাদ দেওয়া হয়েছে। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্যানেল বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও রাখা হয়নি। 

অন্যদিকে, কমিশনের সুপারিশ বেশিরভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম বলেন, দলের প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করা এবং দল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আমরা বেশ কিছু ভালো সুপারিশ করেছিলাম। যেমন- সংসদ নির্বাচনের দলীয় মনোনয়নের জন্য দলের তিন বছরের সদস্য পদ থাকা বাধ্যতামূলক করা এবং দলের লেজুরবৃত্তিক কোনো সংগঠন না থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিলাম। পরপর দুইটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলের নিবন্ধন বাতিলের বিধান বাতিল এবং প্রতি পাঁচ বছর পর পর দলের নিবন্ধন নবায়ন বাধ্যতামূলক করার সুপারিশও আমরা দিয়েছিলাম। এগুলো বাস্তবায়ন হলে তা গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতো। 

সংস্কারের আরও সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য জুলাই সনদ কার্যকর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই সংস্থার কমিশন কিন্তু সরকার গঠন করেছিল। তাই, আমরা আশা করতে পারি অবশ্যই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হবে। আর এখনই এগুলো বাস্তবায়ন করার সবচেয়ে উত্তম সময়।


প্রকাশক/সম্পাদক: আবুল হারিস রিকাবদার
প্রকাশক ও সম্পাদক কর্তৃক প্রথম বাংলাদেশ/শিবপুর, নরসিংদী থেকে প্রকাশিত
ফোনঃ বার্তা-০১৭০০-০০০০০০, বিজ্ঞাপন-০১৯০০-০০০০০০, ই-মেইলঃ prothombangladeshnews@gmail.com