সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আল-কায়েদা এবং তার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশলের কথা জানতে পারে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর। কিন্তু ওই ঘটনার তিন বছর আগে, ১৯৮৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার দুই দেশ কেনিয়া ও তানজানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে প্রায় একই সঙ্গে দুটি বোমা হামলা হয়। তাতে প্রাণ হারায় প্রায় ২৫০ জন। আহত হয় অনন্ত চার হাজার মানুষ।
ওই আক্রমণে ১২ জন আমেরিকান নিহত হয়, কিন্তু হতাহতদের একটা বড় অংশ ছিল স্থানীয় কেনিয়ান ও তানজানিয়ান।
এই দুই হামলার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের নজর পড়ে আল-কায়েদার ওপর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের শীর্ষ ১০ ফেরারি আসামির তালিকায় আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের নাম যুক্ত হয়।
কৌশলগত দিক থেকে টুইন টাওয়ারে হামলার মধ্য দিয়ে এমন এক পর্বের সূচনা হয় যেখানে সন্ত্রাসবাদকে কোনো ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দেয়া হয় সারা বিশ্বে।
১৯৯০ সালের শেষভাগে বিশ্বায়নের দশকে ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলগুলোর সুবাদে এসব হামলার ছবি যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, তেমনি জিহাদি বাণীও পৌঁছে যায় ঘটনা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কোটি মানুষের কাছে।
পূর্ব আফ্রিকায় সাফল্য দেখিয়ে আল-কায়েদা ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে হামলা চালায় ইয়েমেনে। সেখানে নোঙর করে রাখা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কোল-এর ওপর আক্রমণে ১৭ জন মার্কিন নৌসেনা এবং আরও কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়।
পূর্ব আফ্রিকার হামলাগুলোর স্মরণে কেনিয়া ও তানজানিয়ার রাজধানীতে ৭ আগস্ট নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে নিহতদের নামগুলো আবার পড়ে শোনানো হয়। ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তারাও নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
নাইরোবির অনুষ্ঠানে কেনিয়ার জাতীয় সন্ত্রাসবাদ নির্মূল কেন্দ্রের প্রধান মার্টিন কিমানি বলেন, 'ওই হামলার দিন থেকে বড় মাপের হামলা চালানোর জন্য আল-কায়েদার ক্ষিধে বেড়ে যায়। ওই ঘটনার পর থেকে সারা বিশ্বের নানা জায়গায় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চলছে।'
'আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখের’ বলে উল্লেখ করেন নাইরোবি বোমা হামলায় এক নিহত নারীর বোন। এই হামলায় ২০০ জন প্রাণ হারায়। তিনি বলেন, 'এমন একটা দিন নাই যেদিন তার কথা আমার মনে পড়ে না। তার পরিবার, ছেলে-মেয়ে, তার নাতি-নাতনিদের জন্য এটা একটা বেদনার ব্যাপার।'
সেই বোমা হামলার দিনটি ছিল জুলি ওগোয়ের জন্য অন্য যেকোনো দিনের মতোই। মার্কিন দূতাবাসের বাইরে বোমাটি বিস্ফোরিত হয় সকালের মধ্যভাগে। এতে ভবনটির একটা বড় অংশ ধসে পড়ে। পাশের ২৫তলা কো-অপারেটিভ হাউস ব্যাংকও বিধ্বস্ত হয়।
এর পাঁচ মিনিট পর পাশের দেশ তানজানিয়ার রাজধানী দার এস-সালামে মার্কিন দূতাবাসের বাইরে একটা তেলের ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ঘটে।
জুলি বলেন, বিস্ফোরণের ধাক্কায় তার দেহ আকাশে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে। তার মাথার ওপর ঝরে পড়ে ভবনের ধ্বংসাবশেষ। “আমার সারা মুখে ছিল অনেকগুলো ক্ষত। যে নার্স আমার ক্ষত পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিল, তার গায়েও ছোপ ছোপ রক্ত লেগে যায়। সে চিৎকার করে বলে, 'এই মেয়েটি তো রক্তক্ষরণেই মারা যাবে'। এরপর তারা আমার ক্ষতগুলো সেলাই করার চেষ্টা করে। আমাকে বলা হয়: ‘তোমাকে অ্যানেসথেশিয়া দেয়ার সময় নেই।’ সেভাবেই আমার ক্ষতগুলো সেলাই করা হয়।"
এরপর জুলিকে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে এক পাদ্রীকে দেখে জুলি বলেন, “আমি এখানে থাকতে চাই না। আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিন’। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে ঝুলে রয়েছে’। এই কথা শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”
জুলি ওগোয়ের ওপর এরপর অনেকগুলো অস্ত্রোপচার হয়। তার মধ্যে একটি করা হয় জার্মানিতে। তার বাঁ চোখটি অকেজো হয়ে গেলেও বেঁচে থাকতে পেরে তিনি খুশি। কারণ তিনি মনে করেন তার জীবনে আরও ২০ বছর যোগ হয়েছে।
নাইরোবি ও দার এস-সালামে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও সুদানে আল-কায়েদার সন্দেহজনক ঘাঁটির ওপর ক্রুজ মিসাইল ছোড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় আরব লীগ। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও সুদানে মিছিল হয়।
আল-কায়েদার সেই দুর্দণ্ড প্রতাপ এখন আর নেই। সংগঠনটির প্রধান ওসামা বিন লাদেন ২০০৮ সালে পাকিস্তানের আবোটাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডোদের হাতে নিহত হওয়ার পর সংগঠনটি বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এখন মূলত উত্তর আফ্রিকা, আরব উপদ্বীপ, ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র ছোট ছোট দলের মাধ্যমে তৎপরতা চালায়।