ব্রিটেনে ভারতীয় ঔপনিবেশিকতার বিষয়ে একটি গল্প রয়েছে, যেখানে বলা হয় যে, ভারত থেকে ব্রিটিশ সম্রাজ্য বড় কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা পেত না। বরং ব্রিটেনের খরচে চলত ভারতের প্রশাসন। এ কারণেই সেখানে ব্রিটিশ শাসনকাল দীর্ঘ হয়েছিল। মোটকথা ভারতীয় উপনিবেশের এই গল্পে ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটেনের অনুগ্রহ দেখানোর অঙ্গভঙ্গি রয়েছে।
উষা পাটনায়েকের গবেষণা ব্রিটিশদের অনুগ্রহের গল্পকে চপেটাঘাত করেছে। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলের তথ্য, কর এবং বাণিজ্যের ছক বিশ্লেষণ করে এর হিসাব বের করে উষা পাটনায়েক দেখিয়েছেন, ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের শাসনকালে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (তিন হাজার ৭৮০ লাখ কোটি টাকা) বেশি অর্থ ভারত থেকে ব্রিটেনে নিয়ে গেছে ব্রিটিশরা। এটি একটি বিস্ময়কর অংক। ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার বর্তমানে যুক্তরাজ্যের জিডিপির চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। এটি বাংলাদেশের চলতি বছরের বাজেটের ৮১৪ গুণ বেশি।
কেমন করে ঘটল
এটি ঘটেছে বাণিজ্য পদ্ধতিতে। ঔপনিবেশিক সময়ের পূর্বে, ব্রিটেন ভারতীয়দের থেকে বস্ত্র ও চালের মতো পণ্য কিনেছিল এবং স্বাভাবিকভাবে তাদের জন্য অর্থ প্রদান করেছিল- বেশির ভাগই রৌপ্য দিয়ে- যেমনটা তারা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে করেছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের অল্প কিছুদিন পরে ১৭৬৫ সালে আগের বাণিজ্য পদ্ধতি কিছুটা পরিবর্তিত হয় এবং ভারতীয় ব্যবসায়ের ওপর একাধিকবার প্রতিষ্ঠা করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে রাজস্ব সংগ্রহ শুরু করে এবং সেই রাজস্বের এক তৃতীয়াংশ ব্যবহার করে ভারতীয়দের কাছ থেকে পণ্য কেনে। অন্যভাবে বললে, ভারতীয় পণ্যের জন্য মূল্য পরিশোধ করলেও তা ছিল ভারতীয়দেরই। ব্রিটিশরা এখানে বাণিজ্য করে মূলত বিনামূল্যে। ভারতীয়দের থেকে রাজস্ব হিসেবে যে অর্থ নেয়া হচ্ছিল, সেই অর্থের একটি অংশ দিয়েই ব্রিটিশরা ভারতীয়দের সঙ্গে বাণিজ্য করছিল।
এটি একটি কলঙ্ক- বিশদভাবে বললে এটি চুরি। তবুও বেশির ভাগ ভারতীয় যা ঘটছে এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। কারণ, তারা করপ্রদান করছিলেন একজনকে এবং পণ্য বিক্রি করছিলেন আরেকজনের কাছে। যদি একই ব্যক্তি হতেন, তাহলে হয়তো তারা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেত।
ভারতীয়দের কাছ থেকে চুরি করা এসব পণ্যের কিছু ব্রিটেনে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বাকিগুলো অন্যত্র পুনরায় রপ্তানি করা হয়েছিল। অর্থায়নের প্রবাহ বজায় রাখতে এবং ব্রিটেনের শিল্পায়নে লোহা, আলকাতরা ও কাঠের মতো উপকরণ ইউরোপ থেকে আমদানি করতে পুনঃরপ্তানি পদ্ধতির অনুমতি ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভারত থেকে এই পদ্ধতিগত চুরির অর্থের ওপর ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিল।
এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা অন্য দেশ থেকে চুরি করা পণ্য বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম ব্যক্তি থেকে যে দামে কিনেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি দামের বিনিময়ে বিক্রি করেছে ব্রিটিশরা। বিক্রেতাকে ফাঁকি দিলেও তারা সেই পণ্যের শতভাগ কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি মূল্যে বিক্রি করেছে।
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজত্ব গ্রহণের পর উপনিবেশকারীরা রাজস্ব ও ক্রয় পদ্ধতিকে একটি বিশেষ মোড়কে যুক্ত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভেঙে যাওয়ার ফলে ভারতীয়রা সরাসরি অন্য দেশে তাদের পণ্য রপ্তানি করেন। কিন্তু ব্রিটেন নিশ্চিত করেছিল যে সেই পণ্যগুলোর লেনদেন প্রকৃতপক্ষে লন্ডনের হাতেই থাকবে।
এটি কীভাবে কাজ করত
মূলত, কেউ যদি ভারত থেকে পণ্য কিনতে চাইত তাহলে তাকে বিশেষ কাউন্সিল বিলস ব্যবহার করতে হতো। এটি একটি কাগজের মুদ্রা যা ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে দেওয়া হতো এবং সেই বিলগুলো পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল তাদের লন্ডন থেকে সোনা বা রুপা দিয়ে কিনে নেয়া। সুতরাং ব্যবসায়ীরা বিল পেতে লন্ডনকে অর্থ প্রদান করবে এবং তারপর ভারতীয়দের পরিশোধ করতে বিলগুলো ব্যবহার করবে।
ভারতীয়রা স্থানীয় ঔপনিবেশিক কার্যালয়ে বিলগুলো জমা দিয়ে রুপিতে অর্থ নিতেন। এটা সেই অর্থ যা তাদের কাছ থেকে রাজস্ব হিসেবে নেয়া হয়েছে। সুতরাং আগের মতোই তাদের অর্থ থেকে তাদের পণ্যমূল্য পরিশোধ করা হতো। প্রকৃতপক্ষে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এ কারণে সব সোনা ও রুপা শেষ পর্যন্ত লন্ডনে জমা হয়েছে। অথচ এটি পণ্য রপ্তানির কারণে সরাসরি ভারতীয়দের কাছে আসার কথা ছিল।
এই দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থা বোঝায় যে, ভারত বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে চিত্তাকর্ষক বাণিজ্য বজায় রাখলেও ভারতের জাতীয় হিসেবে ঘাটতি ছিল। কারণ, ভারতের রপ্তানির প্রকৃত আয়ের অর্থ সম্পূর্ণভাবে ব্রিটেন অধিকারে নিয়েছিল। ব্রিটেনের অনুগ্রহে ভারত চলেছে বলে যে গল্প রয়েছে, তার কারণ হিসেবে সেই সময়ে ভারতের জাতীয় সেই ঘাটতিকেই দেখানো হয়। কিন্তু আসলে সেটি সত্য নয়।
ব্রিটেন ভারতীয়দের প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করেছিল। যার প্রকৃত মালিক ছিল ভারতীয়রা। সে সময়ে ব্রিটিশ রাজত্বের জন্য ভারত ছিল সোনার ডিমপাড়া হাঁস। এদিকে আমদানির জন্য ব্রিটেন থেকে ঋণ নেয়া ছাড়া ভারতের কোনো বিকল্প ছিল না। সুতরাং সমগ্র ভারতীয় জনগণ অপ্রয়োজনীয় ঋণে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী হয়।
১৮৪০ এর দশকে চীন আক্রমণ, ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিদ্রোহীদের দমনসহ সাম্রাজ্যে সহিংসতার ব্যয় নির্বাহ করতে এই ছলছাতুরি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল ব্রিটেন এবং যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহে ভারতীয়দের কর বাড়ানো হয়েছিল। পাটনায়েক যেমন বলেছেন, ‘ভারতীয় সীমান্তের বাইরে ব্রিটেনের বিজয়ের সব যুদ্ধের ব্যয়ের জন্য সর্বদা বা মূলত ভারতীয় রাজস্বে চার্জ করা হয়েছিল।’
এখানেই শেষ নয়। ইউরোপে পুঁজিবাদের বিস্তার এবং কানাডার মতো ইউরোপীয় বসতি অঞ্চলগুলোর অর্থায়েনে ব্রিটেন ভারত থেকে অর্থের এই প্রবাহ ব্যবহার করেছিল। সুতরাং শুধুমাত্র ব্রিটেনের শিল্পায়নেই নয় বরং পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের শিল্পায়নের অর্থ এই উপনিবেশ থেকে এসেছে। পাটনায়েক ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ভারততে চারটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক সময়ে চিহ্নিত করেছেন। প্রতিটি সময়ের মাঝামাঝি থেকে সুদের হারে (প্রায় ৫ শতাংশ, যা বাজারের হারের চেয়ে কম) যৌগিক গণনা করেছেন। সব প্রকার হিসেব সম্পন্ন করে তিনি মোটামুটি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তা হলো ভারতীয় উপনিবেশ থেকে ব্রিটেন হাতিয়ে নিয়েছে ৪৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, এই চিত্রটি রক্ষণশীল এবং রাজত্বের সময় ভারতের ওপর চাপিয়ে দেয়া ব্রিটেনের ঋণগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এটা একটি সাধারণ হিসাব। কিন্তু প্রকৃত বেহাত হওয়া অর্থ হিসাবের বাইরে। ভারত যদি তার নিজস্ব কর রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বিনিয়োগ করতে সক্ষম হতো- যেমন জাপান করেছিল, তাহলে ইতিহাসে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারত, যা এখন জানার কোনো উপায় নেই। ভারত বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তিধর হতে পারত। এ ছাড়া দারিদ্র্য ও দুঃখের শতাব্দীর প্রতিরোধ করতে পারত।
অথচ ব্রিটেনের কিছু শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ভারতকে অনুগ্রহ করার গোলাপী কাহিনিী প্রতিষেধকের মতো ব্যবহার করছে। রক্ষণশীল ইতিহাসবিদ নিল ফার্গুসন দাবি করেছেন যে, ব্রিটিশ শাসন ভারতকে ‘বিকাশ’ করতে সহায়তা করেছে। ডেভিড ক্যামেরন যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বলেছিলেন, ব্রিটিশ শাসন ভারতের জন্য বিনামূল্যে সহযোগিতা ছিল। এই কল্পকাহিনী উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ পেয়েছে।
২০১৪ সালে ইউগভ জরিপ অনুসারে ব্রিটেনের ৫০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঔপনিবেশিকতার সময়ে উপনিবেশগুলো ব্রিটেনে থেকে উপকৃত হয়েছে।
তবুও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমগ্র ২০০ বছরের ইতিহাসের সময়, প্রতি মাথাপিছু আয় প্রায় বৃদ্ধি পায়নি। প্রকৃতপক্ষে, ১৯ শতকের শেষ ভাগে- ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের আড়ালে- ভারতে আয় অর্ধেক ভেঙে পড়ে। ভারতীয়দের গড় আয়ু ১৮৭০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত পঞ্চম স্থান হ্রাস পেয়েছিল। লাখ লাখ লোক নীতি-প্ররোচিত দুর্ভিক্ষে অভাবে মারা গিয়েছিলেন। স্পষ্টভাবে পাটনায়েক দেখিয়েছেন, ব্রিটেন ভারতকে উন্নত করেনি বরং ভারত ব্রিটেনকে উন্নত করেছে।
আজ ব্রিটেনের কী করা উচিত? ক্ষমা প্রার্থনা?
অবশ্যই। ক্ষতিপূরণ? পাটনায়েক যে হিসাব শনাক্ত করেছেন তা পূরণ করার মতো অর্থ ব্রিটেনের নেই। এখন আমরা সোজাসুজি গল্প শুরু করতে পারি। আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে যে, ব্রিটেন উদারতা থেকে ভারতকে নিয়ন্ত্রণে রাখেনি বরং লুটপাটের জন্য রেখেছিল। তাদের শিল্পের উন্নতি তাদের বাষ্প ইঞ্জিন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘটেনি। যেমনটি আমাদের বইয়ে লেখা রয়েছে। বরং সত্যটা হলো তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকদের থেকে সহিংস চুরির মাধ্যমে এই উন্নতি সাধন করেছে।