ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫
আপডেট : ৪ আগস্ট, ২০১৮ ১০:৫৯

বাচ্চাদের কোমল ডানায় করে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি-জামায়াত

নিজস্ব প্রতিবেদক
বাচ্চাদের কোমল ডানায় করে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি-জামায়াত

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের রাস্তা ছেড়ে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, শিক্ষার্থীরা এমনই অভিনব ঘটনা ঘটিয়েছে যে, তিনি দেশে থাকলে তাদের অটোগ্রাফ নিতে আসতেন। ঘাতক বাসের চাকায় পিষ্ট কলেজ শিক্ষার্থীর দুঃখজনক মৃত্যুর পর থেকে তাদের সহপাঠীরা ঢাকায় বলতে গেলে ‘বিপ্লব’ ঘটিয়ে দিয়েছে। বাচ্চারা তাদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড দিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মে ভরা আমাদের সমাজের ফাঁপা ভেতরটা বের করে এনেছে। সরকারি-বেসরকারি কত গাড়ির চালকের যে লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই, সেটি ছেলে-মেয়েরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিশৃঙ্খল ঢাকায় কিছুটা হলেও শৃঙ্খলার নমুনা দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তবে প্রশ্ন হল, কতদিন আর রাস্তায় এভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করবে আমাদের ছেলে-মেয়েরা?  

আন্দোলনরত কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকটি ধরন আছে। একদল খুব শালীন আর স্মার্ট। বিনয়ী ভাষায় বড় বড় আংকেলদের ইজ্জত পাংচার করে দিচ্ছে এরা। ‘আংকেল আপনার লাইসেন্স দেখি!’ বলে লজ্জার সাগরে ফেলে দিচ্ছে। বুড়া বুড়া আংকেলগুলো অসহায় এর মত লজ্জা পাচ্ছেন। এম্বুলেন্স আসলে ছেড়ে দিচ্ছে, রিকশাগুলোকে পর্যন্ত লাইন ধরে যেতে বাধ্য করছে। মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি কেউ বাদ যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, ‘বিপ্লব’ হয়েছে দেশে। সাধারণ মানুষ আবেগে ভেসে যাচ্ছে, আমরাও খুব আশাবাদী হয়ে উঠছি। তবে আশাবাদের উল্টো পিঠেই আছে আশঙ্কা। কারণ শিক্ষার্থীদের আরেক দল আছে, পুলিশ পেলেই খুব অশালীন ভাষায় স্লোগান দিচ্ছে আর পুলিশকে আক্রমণ করছে।

আমার সামনেই বৃহস্পতিবার মিরপুর রোডে এক পুলিশ কর্মকর্তার উপর আক্রমণ হল। পুলিশের মোটর সাইকেলটি পুড়িয়ে দেয়া হল। এই দৃশ্য দেখে কিছু শিক্ষার্থী খুব আফসোস করল, কিন্তু আক্রমণকারীরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় এরা কোনো বাধা দিতে পারেনি। পুলিশের সেই সার্জেন্ট শিক্ষার্থীদের সাথে সামান্য তর্ক করেছিল, তাই তার এই নগদ শাস্তি। একজন ইউনিফর্মধারী নিরাপত্তারক্ষীকে আঘাত করা যায় না। যারা পুলিশকে আক্রমণ করে তারা সন্ত্রাসী। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ হলে এক বিষয়। আন্দোলন সংগ্রামে পুলিশ অনেক সময় পাল্টা আঘাত পায়। ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকলে আমরা ক্ষেপে যাই, আবার পুলিশ হওয়ার জন্যই ছাত্র-ছাত্রীরা রাত-দিন পড়াশুনা করে।

রাস্তায় একজন পোশাক পরা পুলিশকে আলাদা পেয়ে তার উপর আক্রমণ করা, তার মোটর সাইকেলকে পুড়িয়ে দিয়ে আবার রাস্তার এক পাশে প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া বিরাট বড় অডাসিটি। কারণ পুলিশের পোশাক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বহন করে। পুলিশ যখন রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীদের জোর করে বাসায় পাঠাতে চাইল, তখন আমরাই প্রতিবাদ করেছি। পুলিশের অন্যায় দেখে আমরাও সহ্য করি না। কিন্তু পুলিশের পোশাককে শ্রদ্ধা করি, কারণ এটি আমার রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে। পুলিশের উপর আক্রমণ ভালো কাজ হচ্ছে না।

এদেশে শুধু পুলিশ একা অনিয়ম করে না। আমাদের সবার বাবা-মা শতভাগ সৎ, এমন দাবি কেউ বুকে হাত দিয়ে করতে পারবে? বাবা অথবা মা যে ঘুষ খান, এটা হয়ত অনেকেই আমরা জানিনা।  ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে যারা পাস করেছে তারাও কিন্তু শিক্ষার্থী ছিল। ঢাকার প্রায় সব মানুষ নিয়ম ভাঙে। ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালায়, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, ওভারব্রিজ বাদ দিয়ে ব্যস্ত রাস্তার মাঝখান দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড় দেয়। সিগন্যাল মানে না। চাররাস্তার মোড় থেকে পুলিশ চলে গেলেই আমাদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। কে কার আগে যাবে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে জ্যাম লাগাই আমরাই। আমরা ওজনে কম দিই, পরীক্ষায় নকল করি। হঠাৎ রাস্তার মাঝখান দিয়ে দৌড় মারি, রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারের রড কেটে শর্টকাট রাস্তা তৈরি করি।

এদেশে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে পুলিশ আর ডাক্তার। সে তুলনায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অনেক কম পরিশ্রম করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা টিএনও সাহেব যখন এসি রুমে বসে দেশ উদ্ধার করেন, তখন পুলিশ ভাই-বোনেরা প্রচণ্ড গরম আর ধুলাবালির ভেতর অচল ঢাকাকে কোনোমতে সচল রাখার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। পুলিশের মত কষ্ট কেউ করে না এই ঢাকায়। সিভিক সেন্সবিহীন আড়াই কোটি মানুষের শহর ঢাকায় পুলিশ যে পরিশ্রম করে সেটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বা শহরে বিরল।

পুলিশ সদস্যদের অনেকে ঘুষ খায়। কেন ঘুষ খায়? পুলিশ যে চাকরি নেয়ার সময় সব যোগ্যতা থাকার পরও ১০/১৫ লাখ টাকা ঘুষ দেয়, কাকে দেয়, কারা পায় এই টাকা? একবার সবাই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। একজন কনস্টেবল যখন নিজের মায়ের বা বউ এর গয়না বিক্রি করে, সবেধন নীলমণি এক চিলতে জমি বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে ঘুষের টাকা ম্যানেজ করে তখন সে টাকা পায় কারা? রাজনীতিবিদরা নেয়, সিনিয়র কর্মকর্তারা নেয়। এই টাকা উঠানোর জন্য কনস্টেবল যদি প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘুষ খান, তখন আমরা কি শুধু পুলিশকে দোষারোপ করেই দায়িত্ব শেষ করে দিতে পারি? সব পুলিশ তো ঘুষ খায় না। অনেক সৎ পুলিশ সদস্যের সাথে আমার পরিচয় আছে। শুধু পুলিশকে ভিলেন বানানোর আগে পুরো সমাজের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেয়া উচিত নয় কি?

শিক্ষার্থীদের এক দল যে পুলিশকে এমনি এমনি আক্রমণ করছে আমি সেটা মনে করি না। খুব কৌশলে পুলিশকে হাস্যরসের পাত্র করে দিতে পারলে, পুলিশের গায়ে হাত তুলতে পারা যদি ডালভাতের মত সহজ হয়ে যায়, তখন  বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা সহজ হয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন। স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্ম পড়া পুলিশের উপর আক্রমণ করে যদি বিচারের সম্মুখীন না হওয়াটা এতই সহজ হয়ে যায়, তখন মানুষ সারাদেশে অরাজকতা করবে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট চাইছে পুলিশকে দুর্বল করে, অরাজকতার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ফেলে দিতে। জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের ভূমিকা সারা বিশ্বে প্রশংসিত। আজ আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাইক পুড়িয়ে দিচ্ছে, শুধু একটু তর্ক করেছে বলে!

রাত ১১টা, ১২টার সময় কিছু বড় ছেলেকে দেখলাম ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে! এরা কারা।  মালিবাগে গাড়ি ভাঙচুর করেছে এমন একটা দল। শোনা গেছে, নীলক্ষেতে নকল কলেজ কার্ড বানানোর চেষ্টা করছে একদল ছেলে। সারাদিন কলেজ শিক্ষার্থীদের পানি, জুস, বিস্কুট, খাবার যোগান দিল কারা? ইন্টারনেটে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ভুয়া খবর প্রচার করল কারা? এখন তো সংসদে অধিবেশন চলছে না। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর নামে ভুয়া সংবাদ প্রচার করছে কারা? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ বিএনপি-জামায়াত জোট যেকোনো জনপ্রিয় ইস্যু-কেন্দ্রিক সাধারণের আন্দোলনকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। নিজেদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেলে, অথচ এই ইস্যুতে কোনো আন্দোলন তৈরি করতে পারছে না। কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের একটা যৌক্তিক আন্দোলনে নির্লজ্জের মত সমর্থন দিয়ে, ছেলে-মেয়েদের মাঝে নিজেদের ক্যাডারদের মিশিয়ে দিয়ে বিএনপি-জামায়াত যত মূলত সুন্দর একটা আন্দোলনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করল। অন্যদিকে দেশের কিছু ‘সুশীল’ নাগরিক আছেন যারা নিজেদের সন্তানকে এসি রুমে আগলে রেখে, পরের সন্তানকে রাস্তায় থাকার উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন।

বাচ্চারা তোমরা অনেক ব্রিলিয়ান্ট। তোমরা এই দেশের রাজনীতিবিদ আর আমলাদের চেহারা চিনে ফেলেছ। জনগণের সাথে প্রতারণা করেই এদের যত ঠাটবাট। ব্যতিক্রম একজন রাজনীতিবিদ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তোমরা বড় হলে জানবে, এই মানুষটির নিজের নামে কোনো বাড়ি নেই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮/২০ ঘণ্টা যিনি দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। উনার পুরো পরিবার দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। উনার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার মূল্য কত, সেটি নিশ্চয় তোমরা রোহিঙ্গা আর ফিলিস্তিনিদের দেখে বুঝতে পার। তাছাড়া তোমাদের সকল দাবি সরকার ইতোমধ্যে মেনে নিয়েছে। তবে তুলনামূলক নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে সময় লাগবে। তোমাদের কাছে অনুরোধ, বিএনপি-জামায়াত যেন তোমাদের কোমল ডানায় ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার অপচেষ্টা করতে না পারে।

তোমরা সমাজকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছ, সমাজ-রাষ্ট্র এই শিক্ষা নিয়েছে কি না, সেটি বুঝতে একটু সময় লাগবে। সিস্টেমকে বদলাতে হবে। দুর্নীত আর অনিয়মের শিকড় কোথায়, সেটি খুঁজে বের কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু তোমরা দুর্নীতি কর না, তোমরা শতভাগ সৎ। দুর্নীতি করি আমরা বড়রা। বড়রা যদি নিজে থেকে না বদলায়, তাহলে এই ধাক্কাও খুব একটা কাজে লাগবে না। বড়রা বদলাচ্ছে কি না, সেটি দেখার জন্য বড়দের এখন কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

বাচ্চারা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ক্লাসে ফিরে গেলেই যে বড়রা সিস্টেম বদলাবে, তার নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকে। উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকরা কোন কোন জায়গায় রাস্তায় নেমেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এই শ্রমিকরা যদি আবার নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তখন পুরো পাবলিক সেন্টিমেন্ট সরকারের বিরুদ্ধে যাবে। শ্রমিকদের একটা বড় অংশ সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুসারী। তাই সব দিকে সামাল দিতে হবে সরকারকেই।

উপরে